সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:১৫ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক: নারীর উন্নয়ন নিশ্চিত করতে এবং নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে জেন্ডার বাজেটের যথাযথ বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয় বাড়ানোর পাশাপাশি সমন্বিত তথ্য-উপাত্তভিত্তিক পর্যালোচনার ওপর জোর দিয়েছেন বাজেটবিষয়ক সংলাপে অংশগ্রহণকারী বক্তারা।
সংলাপে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের পরিচালক (গার্লস রাইটস) কাশফিয়া ফিরোজ বলেন, আমরা সারাদেশে জরিপ চালিয়ে দেখছি— অংশগ্রহণকারীদের প্রায় ৩৫ শতাংশের মতে যৌন হয়রানির ভয় বাল্যবিয়ের অন্যতম মূলকারণ। ২৫ দশমিক ৬ শতাংশের মতে, সামাজিক বিভাজনজনিত উদ্বেগের কারণে বাবা-মা মেয়েদের অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেন। জরিপে অংশগ্রহণকারী অভিভাবকদের মধ্যে ৬২ শতাংশ মা জানিয়েছেন সহিংসতার ভয়ে তারা তাদের মেয়েদের স্কুল পিকনিকে অংশ নিতে দেন না, যেখানে বাবাদের মধ্যে ৫৪ দশমিক ১ শতাংশ তাদের মেয়েদের প্রাইভেট টিউশনে যেতে দিতে চান না।
জাতীয় বাজেট সামনে রেখে সোমবার (৬ জুন) রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রগতি ইনস্যুরেন্স ভবনে ‘নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে কেমন বাজেট চাই’ শীর্ষক এ সংলাপের আয়োজন করে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এবং সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)।
আলোচনায় আলোচকরা বলেন, বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে নারীর ক্ষমতায়ন। জাতীয় বাজেটেও জেন্ডার বাজেটের বরাদ্দ রয়েছে বেশ কিছু মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু সেই বাজেটের যথাযথ বাস্তবায়নে কাঠামোতে পরিবর্তন প্রয়োজন। কোন মন্ত্রণালয়ে সুনির্দিষ্টভাবে বাল্যবিয়ে এবং সহিংসতা প্রতিরোধে কত শতাংশ বাজেট ব্যয় হচ্ছে, তার সমন্বিত ডাটা সংগ্রহ এবং তা পর্যালোচনার মধ্যদিয়ে ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে কার্যকরী ভূমিকা পালনে সক্ষম।
আলোচনাসভায় মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির পোগ্রাম অ্যাসোসিয়েট নাদিয়া নওরিন। তিনি বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রভূত উন্নতি হলেও নারীর প্রতি সহিংসতা এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিভিন্ন সহিংসতা প্রতিরোধে যে আইন রয়েছে তার সঠিক প্রয়োগ এবং একই সঙ্গে বাজেটে সহিংসতা রোধে বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। যদিও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে নারীদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে কিন্তু তা সুনির্দিষ্ট নয়। এ বরাদ্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট। বাংলাদেশে জেন্ডার বাজেটের যে কাঠামো রয়েছে তা নারীদের প্রতি সহিংসতার ভয় প্রতিরোধে কার্যকর হচ্ছে না, তাই এ কাঠামোর পরিবর্তন প্রয়োজন।
সহিংসতার ভয় প্রতিরোধে বাজেট কাঠামোর চারটি স্তম্ভের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, নারী বিষয়ে বিভাজিত তথ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে আলোচনার ওপরে গুরুত্ব দেন তিনি। উপস্থাপনার শেষ পর্যায়ে তিনি বলেন, নারীদের ভেতরে সহিংসতার ভয় থাকলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন অর্থহীন হয়ে যাবে।
জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনের সদস্য আরোমা দত্ত বলেন, বাংলাদেশ সরকার জেন্ডার বাজেট নিয়ে সচেতন। বেশকিছু মন্ত্রণালয়ের জন্য এ জেন্ডার বাজেট বরাদ্দ রয়েছে। তবে এর বাস্তবায়নের যথাযথ কার্যকারিতা মনিটরিংয়ের জন্য বাজেট কোথায় কীভাবে খরচ হচ্ছে সে বিষয়ে সমন্বিত ডাটা প্রয়োজন। তবেই নারীর উন্নয়নে যথাযথ বাজেটের প্রয়োগ সম্ভব হবে। পাশাপাশি প্রযুক্তির মাধ্যমে সব মন্ত্রণালয় থেকে সমন্বিত ডাটা সংগ্রহের মাধ্যমে আইন ও নীতিমালার বাস্তবায়নে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলাও সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ডাটার ঘাটতির ফলে আমরা একই জায়গায় আটকে আছি। বিদ্যমান ঘাটতিগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো নিরসনে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। সহিংসতার ভয় নিরসনে সহিংসতার বিরুদ্ধে আরও শক্তিশালী প্রচারণার ওপর জোর দেন তিনি। পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে এ গবেষণাটিকে আরও বেশি জায়গায় নিয়ে যাওয়া, ডাটা সংগ্রহের পরিসর আরও বৃদ্ধি করা, এবং ফলো-আপ নিশ্চিত করার সুপারিশও দেন তিনি।
কাশফিয়া ফিরোজ বলেন, সহিংসতার ভয়েই মেয়েরা তাদের সম্ভাবনার পথে আগাতে পারছে না। আমরা চাই বাজেটে, আইনে, নীতিমালায় এ ভয়ের প্রতিরোধ বিষয়টি উঠে আসুক। ঘর থেকে শুরু করে জনসমাগমে-সর্বত্র এ ভয় বিদ্যমান। আমরা সারাদেশে জরিপ চালিয়ে দেখেছি, অংশগ্রহণকারীদের প্রায় ৩৫ শতাংশের মতে যৌন হয়রানির ভয় বাল্যবিয়ের অন্যতম মূলকারণ। ২৫ দশমিক ৬ শতাংশের মতে সামাজিক বিভাজনজনিত উদ্বেগের কারণে বাবা-মা মেয়েদের অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেন। জরিপে অংশগ্রহণকারী অভিভাবকদের মধ্যে ৬২ শতাংশ মা জানিয়েছেন সহিংসতার ভয়ে তারা তাদের মেয়েদের স্কুল পিকনিকে অংশ নিতে দেন না, যেখানে বাবাদের মধ্যে ৫৪ দশমিক ১ শতাংশ তাদের মেয়েদের প্রাইভেট টিউশনে যেতে দিতে চান না।
তিনি বলেন, এ ভয়ের প্রতিরোধে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট, বিশেষ করে বাজেটের রিফ্লেকশন বুঝতে আমরা এ বাজেট ফ্রেমওয়ার্ক এনালাইসিসটি করি। নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা রয়েছে, কিন্তু বাজেটে সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ আমরা দেখতে পাই না। আমরা দেখতে চাই কোনো মন্ত্রণালয় বাজেটের কতটুকু সুনির্দিষ্টভাবে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে কাজ করবে, সহিংসতা প্রতিরোধে কতটুকু বরাদ্দ এবং বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ভয়ের বিষয় অনুভব করার বিষয়, প্রকাশ করার বিষয়। যার ফলে বাজেটে তার প্রতিফলনও সময়সাপেক্ষ। সারাবিশ্বেই সহিংসতা বাড়ছে, কমছে না। সহিংসতার ফলে যেই ক্ষতি হয় তা ব্যক্তিকে ছাপিয়ে রাষ্ট্রের ক্ষতি, যা অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলে। নারীর প্রতি সহিংসতা এবং সহিংসতার ভয় প্রতিরোধে আইন ও নীতিমালাগুলো নিশ্চিত এবং বাস্তবায়নে যথাযথ অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত প্রয়োজন।
আলোচনায় আরও অংশ নেন— বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক সীমা মোসলেম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. তানিয়া হক, ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিজ অ্যান্ড ডাইভারসিটির পরিচালক নবনীতা চৌধুরী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শরমিন্দ নীলোর্মি, ব্রতী সমাজকল্যাণ সংস্থার উপপরিচালক রফিকুল ইসলাম, ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি ডা. মানসী সাহা, বাংলাদেশ উইমেন ইন টেকনোলজির সহ-সভাপতি কানিজ ফাতেমা, নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ড. ফজিলা বানু লিলি, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ইউথ অ্যাডভাইজারি প্যানেল মেম্বার রাফসান, আকাশ এবং প্রীতি।